সর্বশেষ আপডেট

শাওয়ালের ছয়টি রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত



পবিত্র রমজানের পরবর্তী মাস এবং চন্দ্র মাসের দশম মাস হচ্ছে শাওয়াল। শাওয়াল মাসে অনেক আমল রয়েছে এসব আমলের ফজিলতও অনেক বেশী। রমজান মাসের রোযার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। রাসূল সা. তাঁর সাহাবিদের শাওয়াল মাসের ছয় রোযা রাখার প্রতি উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোযা রাখল তারপর শাওয়াল মাসের ছয় রোযাও রাখল ওই ব্যক্তি যেন সারা বছরই রোযা রাখল। [মুসলিম] এ ছয় রোযাকে পুরো একবছরের রোযার সওয়াবের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে এ জন্য যে, বান্দার প্রতিটি ভাল আমলকে আল্লাহ তাআলা ১০ গুণ সওয়াব দান করেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনে বলেন, যে একটি সৎকাজ করবে, সে তার ১০ গুণ সওয়াব পাবে। [সূরা আনআম : ১৬০]
সুতরাং রমজানের ৩০ রোযা আর শাওয়ালের ছয়টিসহ মোট ৩৬টি রোযা হয়। ৩৬ কে ১০ গুণ বৃদ্ধি করলে ৩৬০ হয়। সুতরাং বছরে ৩৬টি রোযা রাখলে যেন পূর্ণ বছর অর্থাৎ ৩৬০ দিনই রোযা রাখা হয়। অতএব, যে ব্যক্তি এভাবে প্রতি বছর ৩৬টি রোযা রাখল সে যেন সারা জীবন রোযা রাখল। [ফাতহুল মুলহিম :৩/১৮৭]
হযরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, রমজানের ৩০ রোযা ১০ মাসের ৩০০ রোযার সমতুল্য; আর শাওয়ালের ছয় রোযা দুই মাসের ৬০ রোযার সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের সিয়াম। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন,“যারা মাহে রমজানের ফরজ রোযা রাখবে, তারপর মাহে শাওয়ালের ছয় রোযা রাখবে তারা সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব অর্জন করবে। [মুসলিম শরীফ :১ম.খন্ড ৩৬৯পৃ:]
এ রোযার ফজিলত সম্পর্কে রাসুল সা. আরো ইরশাদ করেন, “যারা পবিত্র রমজানের রোযা রাখার পর শাওয়ালের আরো ছয়টি রোযা রাখবে তারা সেই ব্যক্তির মত হয়ে যাবে যে ব্যক্তি সদ্য তার মায়ের পেট থেকে দুনিয়াতে আগমণ করেছে। অর্থাৎ শিশু যেভাবে পুত-পবিত্র তথা নিষ্পাপ, তার কোন গোনাহ নেই, যারা শাওয়ালের ছয় রোযা রাখবে তারাও সেই নিষ্পাপ শিশুর মত হয়ে যাবে। [তিরমিযী শরীফ]
হযরত উবাইদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল সা. কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কি সারা বছর রোযা রাখতে পারব? তখন রাসুল সা. বললেন, “তোমার উপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে” কাজেই তুমি সারা বছর রোযা না রেখে রমজানের রোযা রাখ এবং রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের ছয় রোযা রাখ, তাহলেই তুমি সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব পাবে। [তিরমিযি ১ম খন্ড.১৫৭পৃ:]
একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, প্রিয় নবী সা. আরও এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা শাওয়াল মাসের ৬ দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ওই ৬ দিন রোযা রাখবে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক সৃষ্টি জীবের সংখ্যা হিসাবে তার আমলনামায় নেকি লিখে দেবেন, সমপরিমাণ বদি দূর করে দেবেন এবং পরকালে তার দরজা বুলন্দ করে দেবেন। হযরত সুফিয়ান ছাওরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মক্কায় তিন বছর ছিলাম। মক্কাবাসীর মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রত্যহ জোহরের সময় মসজিদে হারামে এসে বাইতুল্লাহ তওয়াফ করে, নামায পড়ে আমাকে সালাম দিয়ে চলে যায়। ফলে তার ও আমার মাঝে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হলো। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে ডাকল এবং বলল, আমি মারা গেলে তুমি আমাকে নিজ হাতে গোসল দেবে, নামায পড়বে এবং দাফন দেবে। ওই রাতে তুমি আমাকে কবরে একাকী রেখে চলে আসবে না। তুমি আমার কবরের কাছে রাত যাপন করবে এবং মুনকার নকিরের সওয়ালের সময় আমাকে সহায়তা করবে। সুতরাং আমি তাকে নিশ্চয়তা দিই। আমি তার আদেশ মোতাবেক তার কবরের কাছে রাত যাপন করি। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, হঠাৎ ঘোষকের ঘোষণা শুনলাম, হে সুফিয়ান! তোমার রক্ষণাবেক্ষণ ও তালকিনের প্রয়োজন নেই। আমি বললাম, কিসের জন্য? তিনি বললেন, রমজানের রোযা এবং রমজান-পরবর্তী শাওয়ালের ৬টি রোযার কারণে। আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। অজু করে নামায পড়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। তারপর আমি আবার একই স্বপ্ন দেখলাম। সুতরাং আমি উপলব্ধি করলাম যে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে, শয়তানের পক্ষ থেকে নয়। সুতরাং আমি চলে গেলাম এবং বলতে লাগলাম, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রমজানের রোযা এবং শাওয়ালের ৬টি রোযা রাখার তাওফিক দান করুন। অতএব, শাওয়ালের ৬টি রোযার গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ পুণ্যময় নেক আমলে নিজেকে মশগুল রাখা। মহান আল্লাহ্ সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন।
শাওয়ালের রোযা রাখার নিয়ম শাওয়ালের ছয় রোযা শাওয়াল মাসেই শুরু করে শেষ করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে ছয় দিনে ছয় রোযা রাখা যায় আবার মাঝে ফাঁক রেখে পৃথকভাবেও রাখা যায়। উল্লেখ্য যে, শাওয়ালের ছয় রোযার সওয়াব তারা পাবে যারা রমজানের রোযা সঠিকভাবে পালন করেছে। কারণ রমজানের রোযা হচ্ছে ফরজ আর শাওয়ালের রোযা হল মুস্তাহাব। মুস্তাহাবের সওয়াব তখনই পাওয়া যায় যখন ফরজ পালন করা হবে । কারও জিম্মায় যদি রমজানের কাজা রোযা থেকে থাকে, তবে প্রথমে রমজানের কাজা আদায় করে নেবে, এরপর শাওয়ালের রোযা রাখবে। যারা পবিত্র রমজানের যথাযথ কদর করেননি তাদের উচিত এখনই আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা-এস্তেগফার করে আল্লাহ তাআলার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া। গোনাহ ছেড়ে দিয়ে নেক আমলের দিকে ফিরে আসা, অন্যথায় দুনিয়া এবং আখেরাতে আল্লাহ তাআলার ভয়াবহ শাস্তি অনিবার্য। শাওয়ালের ছয় রোযা ও মাসিকের কারণে কাজা হয়ে যাওয়া রমজানের রোযা এক নিয়তে এক সাথে আদায় করা বৈধ হবে না। কেননা শাওয়ালের ছয় রোযার পর্ব রমজানের রোযা পূর্ণ করার পরই আসে। শায়খ ইবনে উসাইমিন রোযার ফতোয়ায় (৪৩৮) প্রমাণ স্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোযা রাখল, তারপর শাওয়ালের রোযা রাখল সে যেন পুরা বছরই রোযা রাখল। আর এটা আমরা জানি যে, যে ব্যক্তির উপর রমজানের কাজা রোযা রয়েছে তাকে রমজানের রোযা আদায়কারী বলা হবে না যতক্ষণ না তার দায়িত্বে থাকা কাজা রোযা সে পূর্ণ করে নেবে।
একটি প্রশ্ন: শাওয়াল মাসের যে কয়দিন বাকী আছে সেদিনগুলো যদি রমজানের কাযা রোযা ও শাওয়ালের ছয় রোযা রাখার জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে কি কাযা রোযার আগে ছয় রোযা রাখা জায়েয হবে?
উত্তর: সঠিক মতানুযায়ী শাওয়ালের ছয় রোযা রমজানের রোযা পূর্ণ করার সাথে সম্পৃক্ত। দলিল হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী
“যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোযা রাখল তারপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন গোটা বছর রোযা রাখল।” [সহীহ মুসলিম :১১৬৪]
হাদীসে উল্লেখিত শব্দটি হরফে আতফ যা
তারতীব বা বিন্যাস ও তাকীব বা ক্রমধারা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এদিক থেকে হাদীসটি প্রমাণ করছে যে, আগে রমজানের রোযা পূর্ণ করতে হবে। সেটা সুনির্দিষ্ট সময়ে আদায় হিসেবে হোক অথবা (শাওয়াল মাসে) কাযা পালন হিসেবে হোক। অর্থাৎ রমজানের রোযা পূর্ণ করার পর শাওয়ালের ছয় রোযা রাখতে হবে। তাহলে হাদীসে উল্লেখিত সওয়াব পাওয়া যাবে। কারণ, যে ব্যক্তির উপর রমজানের কাযা রোযা বাকী আছে সেতো পূর্ণ রমজান মাস রোযা রাখেনি। রমজান মাসের কিছুদিন রোযা রেখেছে। তবে কারো যদি এমন কোন ওজর থাকে যার ফলে তিনি শাওয়াল মাসে রমজানের কাযা রোযা রাখতে গিয়ে শাওয়ালের ছয় রোযা রাখতে পারেননি। যেমন কোন নারী যদি নিফাসগ্রস্ত (প্রসবোত্তর স্রাবগ্রস্ত) হন এবং গোটা শাওয়াল মাস তিনি রমজানের রোযা কাযা করেন তাহলে তিনি জিলক্বদ মাসে শাওয়ালের ছয় রোযা রাখতে পারবেন। কারণ এ ব্যক্তির ওজর শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। অন্য যাদের এমন কোন ওজর আছে তারা সকলে রমজানের রোযা কাযা করার পর শাওয়ালের ছয় রোযা জিলক্বদ মাসে কাযা পালন করতে পারবেন। কিন্তু কোন ওজর ছাড়া কেউ যদি ছয় রোযা না রাখে এবং শাওয়াল মাস শেষ হয়ে যায়তাহলে সে ব্যক্তি এই সওয়াব পাবেন না। – যে ব্যক্তি বিশেষ কোন ওজরের কারণে রমজানের রোযা ভেঙ্গেছে সেটা কাযা করা তার দায়িত্বে ফরজ। রমজানের রোযা ইসলামের পঞ্চবুনিয়াদের অন্যতম। তাই এই ইবাদত পালন প্রাধান্য পাবে এবং ফরজের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়াকে অন্য মুস্তাহাব আমলের উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। শাওয়ালের রোযা ধারাবাহিকভাবে একসাথে রাখা জরুরী নয়। একসাথে বা ভিন্ন-ভিন্ন উভয় ভাবেই শাওয়ালের রোযা আদায় করা যায়। শাওয়ালের রোযা যত দ্রুত রাখা যায় ততোই কল্যাণ। ইরশাদ হয়েছে, তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা করো। [সূরা মায়েদা : ২]
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাতের প্রতি। [সূরা আল ইমরান : ১৩৩]
মুসা আ. বলেছেন, হে আমার রব, আমি তাড়াতাড়ি করে আপনার নিকট এসেছি, যাতে আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হন। আর দেরি করাটা খোদ একটি সমস্যা ও আপদ। শাফেয়ী এবং হাম্বলি মাযহাবের অনুসারীগণ এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। তবে দ্রুত আদায় না করলেও কোনো সমস্যা নেই। সে হিসেবে যদি মাসের মাঝখানে অথবা শেষে আদায় করে নেয়া যায় তবুও কোনো অসুবিধা হবে না।
শাওয়ালের ছয়টি রোযা নিয়ে আমাদের সমাজে ভ্রান্ত কিছু ধারণা ও কুসংস্কার দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করে এ ছয় রোযা শুধু মাত্র মহিলারা রাখবে, বুড়ো ও পুরুষ লোক রাখবেনা। আবার কেউ কেউ মনে করে এ রোযা একবার রাখলে প্রতি বছরই রাখতে হবে। এছাড়া ও আরো বেশ কিছু কুসংস্কার সমাজে দেখা দিয়েছে ।
বাস্তবতা হচ্ছে ইসলামী শরীয়তে এহেন কোন বিধান আরোপ করেনি। ঐসব কিছু হচ্ছে কুসংস্কার ও কুপ্রথা তথা ভ্রান্ত বিশ্বাস। শাওয়ালের রোযা পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধসহ সকলেই রাখতে পারবে। আবার একবার রাখলে বারবার তথা প্রতি বছর রাখতে হবে এইরকম কোন বিধি-বিধান শরীয়তে নেই । ইচ্ছা হলে প্রতি বছর রাখতে পারবেন অথবা নাও রাখতে পারবেন, এটা যার যার ইচ্ছা। এটা মুস্তাহাব, ফরজ নয়। যেহেতু রাসূলের হাদীস দ্বারা এই ছয় রোযার অনেক ফযিলত পাওয়া গেল এবং রাসূল সা. নিজেও শাওয়ালের এ ছয় রোযা রাখতেন এবং উম্মতকে রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, সেজন্য এ রোযা রাখা আমাদের জন্য উচিত। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে যেন শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা এখলাসের সাথে রাখার তাওফিক দান করেন।
আমিন ।

কোন মন্তব্য নেই