মিলাদুন্নবী (সা.) ও সিরাতুন্নবী (সা.)
বিশ্বের বিস্ময়, নবী ও রাসুলগণের সর্বশেষ ও
সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্বনবী হজরত আহমাদ মুজতবা
মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। যাঁর গুণকীর্তনে ভিন্ন
ধর্মের মানুষেরা পর্যন্ত পঞ্চমুখ; কাফির–মুশরিক,
জানের দুশমনরাও যাঁকে ‘আল আমিন’ তথা
মহাসত্যবাদী বা পরম বিশ্বাসী আখ্যায় আখ্যায়িত
করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি; যাঁর আবির্ভাবে কিসরা ও
কাইজারের গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদ ভূমিতে লুটিয়ে
পড়ে; পারস্যের অনির্বাণ অগ্নিকুল চিরনির্বাপিত হয়;
তাঁর সেই শুভাগমনকে বিশ্ববিবেক ক্ষণিকের
তরেও ভুলতে পারে না। বছরের ৩৬৫ দিনও যদি তাঁর
পবিত্র মহামিলাদ বা জন্ম স্মরণ করা হয়, তথাপি রোজ
কিয়ামত পর্যন্ত এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিন্দুমাত্র
হ্রাস পাবে না। তাই তো সারা দুনিয়া প্রতিমুহূর্তে
গাইছে: ‘সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা’।
বালাগাল উলা বি কামা–লি হি, কাশাফাদ দুজা বি জামা-লি হি; হাছুনাত
জামিউ খিছ-লি হি, সাল্লু আলাইহি ওয়া আ-লি হি। ‘সবার
ওপরে আসন যাঁর, তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে
আঁধার; সকল কিছুই সুন্দর তাঁর; দরুদ তাঁকে ও তাঁর
পরিবার।’
মহানবী (সা.)–এর আবির্ভাব দিবসটি আমাদের সমাজে
ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম নামে পরিচিত। ‘ফাতেহায়ে
দোয়াজদাহুম’ কথাটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে।
দোয়াজদাহুম মানে বারো, ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম
অর্থ হলো বারো তারিখের ফাতেহা অনুষ্ঠান।
কালক্রমে এ দিনটি মিলাদুন্নবী (সা.) নামে প্রসিদ্ধি
লাভ করে। এর অর্থ হলো নবী (সা.)-এর জন্ম
অনুষ্ঠান। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে ‘ঈদ’ শব্দ
যোগ হয়ে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’ রূপ লাভ করে,
যার অর্থ হলো মহানবী (সা.)-এর জন্মোৎসব। এ
পর্যায়ে আরেকটি পরিভাষাও প্রচলিত হতে থাকে
‘সিরাতুন্নবী (সা.)’, অর্থাৎ নবী (সা.)-এর
জীবনচরিত বা জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান। এ
দিবসে অনেকে জশনে জুলুছ বা শোভাযাত্রাও
করে থাকেন।
এই মহামানবের জন্মতারিখ নিয়ে সিরাতগ্রন্থ,
জীবনীকার, ইতিহাসবেত্তা ও জ্যোতির্বিদগণের
মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রায়
সবাই এ বিষয়ে একমত যে তাঁর জন্ম হয়েছিল রবিউল
আউয়াল মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার প্রত্যুষে বা
ভোরবেলায়, তথা উষালগ্নে। তাঁর বেলাদাত ও ওফাত
১২ রবিউল আউয়াল হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
তদুপরি প্রিয় নবী (সা.)-এর আগমন ও প্রস্থান একই
দিনে, একই সময়ে—এ কথাও সর্বজন বিদিত। তাহলে
এই দিনে জন্মোৎসব পালন করা হবে, নাকি
প্রস্থানের শোক পালন করা হবে? কথায় আছে:
সৃষ্টির জন্য যাঁদের সৃষ্টি, তাঁরা চির অমর। তা-ই হোক,
তবু প্রিয় নবী (সা.) আজ দুনিয়ার বুকে নেই, সেটিই
ভাবার বিষয়। যা-ই হোক, উৎসব বা শোক পালন বড়
কথা নয়; আসল কথা হলো তাঁর জীবন থেকে
শিক্ষা গ্রহণ করা; কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা;
একমাত্র ইসলামকেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন
মুক্তির অনন্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা। তবেই
আমাদের এ আনন্দ ও বেদনা উভয়ই সার্থক হবে।
অতি পরিতাপের বিষয় যে রবিউল আউয়াল মাস এলে
আমরা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করি। বাণী আর বিবৃতি
প্রচার করি; কিন্তু ফরজ–ওয়াজিব আদায় করি না;
দুর্নীতি ও ঘুষ ছাড়তে পারি না; মিথ্যা বর্জন করতে
পারি না; লোভ, হিংসা, মোহমুক্ত হতে পারি না। এমন
হয় কেন? তবে কি নবীপ্রেমের তাৎপর্য
আমাদের অন্তরে স্থান পেয়েছে?
মনুষ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ
করা। নবী-রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য হলো
মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.)-
এর পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাসুল (সা.) যা যা
করেছেন বা করতে বলেছেন, তা করতে হবে।
আর যা করেননি বা করতে বারণ করেছেন, তা
বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র
কোরআনের ঘোষণা: ‘যা দিয়েছেন তোমাদের
রাসুল (সা.), সুতরাং তা ধারণ করো; আর যা থেকে বারণ
করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা: হাশর-৫৯,
৭)।
আল-কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘বলুন (হে
রাসুল সা.!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে,
তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের
ভালোবাসবেন।’ (সূরা: বাকারা-২, ৩১)। হাদিস শরিফে
আছে: ‘তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ
মুমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি হব তার নিকট তার পিতা,
পুত্র ও সকল মানুষ (এবং যাবতীয় সবকিছু) থেকে
প্রিয়।’ এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসুল
(সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ইমানের পূর্বশর্ত। আর এই
ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মধ্যেই
প্রকাশ পাবে। আমরা যখন উৎসব বা দুঃখ প্রকাশ করি,
তখন কি আমরা সেই প্রকৃত ভালোবাসা ও
আনুগত্যের কথা চিন্তা করি? না আমরা মিষ্টি খাওয়া বা
একটা আনুষ্ঠানিক প্রথাই পালন করি?
হ্যাঁ, মিষ্টি খাওয়াও সুন্নত বটে! তবে কথা হলো,
আমরা বর্তমানে শুধু মিষ্টিজাতীয় সুন্নতগুলো
পালনে অতিমাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছি। কিন্তু
কতগুলো সুন্নতের কথা আমরা একেবারেই
ভুলতে বসেছি। যেমন: দুস্থ ও আর্তের সেবা
করা, গরিব-দুঃখীর দেখাশোনা করা এবং
মানবকল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। উল্লিখিত
বিষয়গুলো ছাড়াও বহু বিষয় রয়েছে, যা রাসুল (সা.)
করেছেন এবং করতে বলেছেন; সেগুলো
আমাদের জন্য সুন্নত, এমনকি অনেকগুলো
ফরজও বটে। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে
উদাসীন। যা–ও কিছু করি, তা–ও কি পরিপূর্ণ করতে
পারি? না; বরং শুধু যেকোনো একটা দিক নিয়েই
আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে
নিজের কর্মপরিধি বাড়ানোর পরিবর্তে অন্য সবার
সমালোচনা করে তৃপ্তি লাভ করি। যার দরুন নিজের
অসম্পূর্ণতা ও অন্যের অসহযোগিতার ফলে পরাভূত
হই বারবার।
মিলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো জন্মলগ্ন বা
জন্ম সম্পর্কে আলোচনা। আমাদের পরিভাষায় মিলাদ
বলতে বুঝি, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর
জন্ম ও জীবনী আলোচনা এবং তাঁর প্রতি মিলাদুন্নবী (সা.) ও সিরাতুন্নবী (সা.)
সালাম পেশ করা। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে
বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল
(সা.)-এর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ
তাঁর প্রতি রহমতের দোয়া করেন; হে বিশ্বাসীগণ!
তোমরা তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ ও যথাযথরূপে সালাম
পেশ করো। (সূরা: আহযাব-৩৩, ৫৬)।
এ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ, পুঁথি-
পুস্তক, গল্প-উপন্যাস, কল্পকাহিনি, ছড়া-ছন্দ, পদ্য-গান,
লিখিত হয়েছে; লেখা হচ্ছে, আরও বহু লিখিত
হবে। এর তাৎপর্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আরও হবে। তবু
এটা নিশ্চিত যে সব ব্যাখ্যার সারব্যাখ্যা, সব কথার
সারকথা, যাতে সবাই একমত যে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর
মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালিমা তৈয়্যবা ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য
নেই, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত। এ কালেমার গূঢ়ার্থ
হাজারো প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এর
মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি
নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ইমানে মুজমাল—‘বিশ্বপ্রভু
আল্লাহর প্রতি আমি ইমান আনলাম, তাঁর সব আদেশ
মেনে নিলাম।’
মোদ্দা কথা, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আসল শিক্ষা
হলো—মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের ভালোবাসার,
কঠোর সাধনার পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য
ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে
সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম
ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা
রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য; যা পবিত্র
কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে—‘তিনি সেই মহান
প্রভু, যিনি রাসুল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও
সত্য ধর্ম সহযোগে, যাতে সেই ধর্মকে প্রকাশ
করতে পারেন সর্বধর্মের শিখরে।’ (সূরা: তাওবা-৯,
৩৩ / সূরা: ফাৎহ-৪৮, ২৮)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম
মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী
অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail
খুব ভালো লিখেছেন। দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে আমাদের সমাজে কিছু ভুয়া আলেম বের হইছে যারা মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবীকে বিদআত বলে গলা ফাটাচ্ছে। অথচ আল্লাহ নিজেই নবীর প্রতি সালাম দেয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
উত্তরমুছুনআল্লাহ আমারদেরকে বিদ্ধেষ থেকে বের হয়ে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। 'আমিন'
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে ভাই এসব মানুষগুলো ইহুদি, নাসারাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। ইহুদিরা আমাদেরকে ইসলাম থেকই বিচ্ছিন্ন করার যে চক্রান্ত করেছে আমরা তার শিকার মাত্র। তারপরও ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের কে সঠিক পথ হতে বিচ্যূত করবেন না
মুছুনআপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আল্লাহ আমাদের কে সঠিক পথ হতে বিচ্যূত করবেন না
উত্তরমুছুন