সর্বশেষ আপডেট

ভূমিকম্প কেন হয়? ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্প হওয়ার কারণ কি ?



ভূমিকম্প কেন হয়?

আবু হুরাইরা (রা.) কতৃক বর্ণিত, আল্লাহর নবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে,
কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খিয়ানত করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না),
জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে,
ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত বিদ্যা অর্জন করা হবে,
একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু তার মায়ের সাথে বিরূপ আচরণ করবে,
বন্ধুকে কাছে টেনে নিবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দিবে,
মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে,
জাতির সবচেয়ে দূর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসক রুপে আবির্ভূত হবে,
সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি জনগণের নেতা হবে,
একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে,
বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হয়ে যাবে,
মদ পান করা হবে (বিভিন্ন নামে মদ ছড়িয়ে পড়বে),
শেষ বংশের
লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দিবে,

এমন সময় আসবে যখন তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে তখন একটি ভূমিকম্প সেই ভূমিকে তলিয়ে দিবে (ধ্বংস স্তুপে পরিণত হবে বা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে)। [তিরমিযি কতৃক বর্ণিত, হাদিস নং –
১৪৪৭] এই হাদিসের মাঝে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে আল্লাহ মহানের পক্ষ থেকে জমিনে কখন
ভুমিকম্পের আজাব প্রদান করা হয় এবং কেন প্রদান করা হয়।

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরণের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়। তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুনাজাত করে। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হত, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলত, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক
করেছেন।’

বিজ্ঞান কি বলে?

ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে ভূপৃষ্ঠের নীচে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় রয়েছে কঠিন ভূত্বক। ভূত্বকের নীচে প্রায় ১০০ কি.মি. পূরু একটি শীতল কঠিন পদার্থের স্তর রয়েছে। একে লিথোস্ফেয়ার (Lithosphere) বা কঠিন শিলাত্বক নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কঠিন শিলাত্বক (লিথোস্ফেয়ার)সহ এর ভূপৃষ্ঠ বেশ কিছু সংখ্যক শক্ত শিলাত্বকের প্লেট (Plate) এর মধ্যে খন্ড খন্ড অবস্থায় অবস্থান করছে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে এই প্লেটের চ্যুতি বা নড়া-চড়ার দরুণ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।

ভূমিকম্প বিষয়ক কুরআনতত্ত্ব

ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কোরানে
সূরায়ে ‘যিলযাল’ নামে একটি সূরাই নাযিল
করা হয়েছে। মানুষ শুধু কোন ঘটনা
ঘটার কার্যকারণ সম্পর্কে জানতে
আগ্রহী হয় এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞানও এই
কার্যকারণ সম্পর্কেই আলোচনা করে
থাকে। কিন্তু কুরআনুল কারীম একই
সাথে কোন ঘটনা ঘটার কার্যকারণ
বর্ণনার পাশাপাশি উক্ত ঘটনা থেকে
শিক্ষনীয় বিষয় কি এবং এই ঘটনা থেকে
অন্য আরো বড় কোন ঘটনা ঘটার
সংশয়হীনতার প্রতি ইংগিত করে। ভূমিকম্প
বিষয়ে কুরআনুল কারীমে দু’টি শব্দ
ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হল ‘যিলযাল’, যার
অর্থ হল একটি বস্তুর নড়াচড়ায় অন্য
আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। দ্বিতীয়
শব্দটি হল ‘দাক্কা’, এর অর্থ হল প্রচন্ড
কোন শব্দ বা আওয়াজের কারণে
কোন কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া।
পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প
ঘটছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের
অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বকে চ্যুতি বা
স্থানান্তরের কারণে। কিয়ামতের দিন
আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো
টুকরো হয়ে ধুলিকনায় পরিণত হবে এবং
তা হবে ফেরেশেতা হযরত
ইসরাফিলের ( আ.) সিঙ্গায় ফুৎকারের
কারণে, যাকে বলা হয় ‘দাক্কা’। যা হবে
এক প্রচন্ড আওয়াজ।

পৃথিবীতে মাঝে মাঝে কঠিন
শিলাত্বকের স্থানান্তরের কারণে ঘটে
যাওয়া ভূমিকম্প আমাদেরকে এ কথার
প্রতি ইংগিত করে যে, একদিন ওই ‘দাক্কা’
সংঘটিত হবে, যার নাম কেয়ামত। তখন এই
চাকচিক্যময় দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে
পরিণত হবে। মানুষ যেন
ভুলে না যায়, দুনিয়াকেই তার আসল ঠিকানা
মনে না করে, তাই মাঝে মাঝে মহান
আল্লাহ ভূমিকম্পসহ আরো অন্যান্য
প্রাকৃতিক দূর্যোগ দিয়ে মানুষকে
সতর্ক করে থাকেন।

ভূমিকম্প একটি আজব

আল্লাহ মহান পবিত্র কোরানে ইরশাদ
করেছেন, বল, আল্লাহ তাআলা
তোমাদের উপর, তোমাদের উপর
থেকে (আসমান থেকে) অথবা
তোমাদের পায়ের নীচ থেকে
আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি
তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে
একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ
গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে
সক্ষম।” (সূরা আল আনআম : ৬৫)

আল-বুখারি তার সহিহ বর্ণনায় জাবির ইবনে
আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন,
তিনি বলেন, যখন তোমদের উপর
থেকে (আসমান থেকে) নাজিল
হলো তখন রাসূল (স) বললেন, আমি
তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা
করছি, অথবা যখন, অথবা তোমাদের
পায়ের নীচ থেকে আজাব নাযিল
হলো, তখন তিনি (সা.) বললেন, আমি
তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা
করছি। (সহিহবুখারি, ৫/১৯৩)

আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের
তাফসিরে বর্ণনা করেন, “বল, আল্লাহ
তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের
উপর থেকে (আসমান থেকে)- যার
ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা
ঝড়ো হাওয়া; আর অথবা তোমাদের
পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে
সক্ষম- যার ব্যাখ্যা হলো, ভুমিকম্প এবং
ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর
অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া।)

বান্দার উপর আজব কেন আসে?

হজরত আলী [রা.] হতে বর্ণত রসুল
[সা.] ইরশাদ করছেন, যখন আমার উম্মত
যখন ১৫ টি কাজে লিপ্ত হতে শুরু
করবে তখন তাদের প্রতি বালা মসীবত
আপাতিতি হতে আরম্ভ করবে।
কাজগুলো হল:

১. গণীমতের মাল ব্যাক্তিগত সম্পদে
পরিণিত হবে।
২. আমানতের সম্পদ পরিনত হবে
গনীমতের মালে।
৩. জাকাত আদায় করাকে মনে করবে
জরিমানা আদায়ের ন্যায়।
৪. স্বামী স্ত্রীর বাধ্য হবে।
৫. সন্তান মায়ের অবাধ্য হবে।
৬. বন্ধু-বান্ধবের সাথে স্বদব্যাবহার করা
হবে।
৭. পিতার সাথে করা হবে জুলুম।
৮. মসজিদে উচ্চস্বরে হট্টোগোল
হবে
৯. অসাম্মানী ব্যাক্তিকে জাতির নেতা
মনে করা হবে।
১০. ব্যাক্তিকে সম্মান করা হবে তার
অনিষ্ট থেকে বাচার জন্য।
১১. প্রকাশ্যে মদপান করা হবে।
১২. পুরুষ রেশমী পোষাক পরবে।
১৩. গায়িকা তৈরি করা হবে।
১৪. বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হবে।
১৫.পুর্ববর্তী উম্মতদের (সাহাব,
তাবে, তাবেঈন) প্রতি অভিসমাপ্ত করবে
পরবর্তীরা।

এই কাজগুলি যখন পৃথিবীতে হতে শুরু
হবে তখন অগ্নীবর্ষী প্রবল ঝড়,
ভুমিকম্প ও কদাকৃতিতে রূপ নেয়ার
অপেক্ষা করবে। এখন একটু চিন্তা করা
উচিত যে আমরা এগুলোর মাঝেই লিপ্ত
রয়েছি। আর যখন আমাদের উপর
মুসীবত আসে তখন প্রকৃতির বা
মানুষের বা অন্যান্য জিনিসের দোষ
দেই। আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত যে সব
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন আমরা
হই তা আসলে আমাদের গুনাহের
কারনেই এত আযাব।

ভূমিকম্প হলে করণীয় কি?

যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা
সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়,
তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট
অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার
জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে
অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা
করা যেভাবে রাসূল (সা.) সূর্য গ্রহণ
দেখলে বলতেন, যদি তুমি এরকম কিছু
দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান
আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা
প্রার্থনা কর। [বুখারি ২/৩০ এবং মুসলিম
২/৬২৮]

বর্ণিত আছে যে, যখন কোন ভূমিকম্প
সংগঠিত হতো, উমর ইবনে আব্দুল
আযিয (রহ) তার গভর্ণরদের দান করার
কথা লিখে চিঠি লিখতেন।
ভুমিকম্প একটি কেয়ামতের আলামত
আবূল ইয়ামান (রহ.) আবূ হুরায়রা (রা.)
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি [সা.]
বলেছেন, কিয়ামত কায়েম হবে না,
যে পর্যন্ত না ইল্ম উঠিয়ে নেওয়া
হবে, অধিক পরিমাণে ভুমিকম্প হবে,
সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ
পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। (হারজ অর্থ
খুনখারাবী) তোমাদের সম্পদ এত বৃদ্ধি
পাবে যে, উপচে পড়বে। [সহিহ বুখারি,
অধ্যায় : ১৫/ বৃষ্টির জন্য দুআ, হাদিস
নাম্বার : ৯৭৯]

পবিত্র কোরানের একাধিক আয়াতে বলা
হয়েছে যে, জলে স্থলে যে
বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তা মানুষেরই
কৃতকর্মের ফল। আল্লাহপাক মানুষের
অবাধ্যতার অনেক কিছুই মাফ করে
দেন। তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়।
কোরান নাজিল হওয়ার পূর্বেকার অবাধ্য
জাতি সমূহকে আল্লাহপাক গজব দিয়ে
ধ্বংস করেছেন। সে সবের অধিকাংশ
গজবই ছিল ভুমিকম্প। ভুমিকম্প এমনই
একটা দুর্যোগ যা নিবারন করার মতো
কোন প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করতে
পারে নাই। এর পূর্বাভাষ পাওয়ার মতো
কোন প্রযুক্তিও মানুষ আজ পর্যন্ত
আবিষ্কার করতে পারেনাই। হাদিস
শরীফেও একাধিকবার বলা হয়েছে
যে, মানুষের দুষ্কর্মের জন্যই
ভুমিকম্পের মতো মহা দুর্যোগ
ডেকে আনে। কুরআন এবং হাদিসে
আদ, সামুদ, কওমে লুত এবং আইকার
অধিবাসীদের ভুমিকম্পের দ্বারা ধ্বংস
করার কাহিনী বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা
হয়েছে।

একটু ভাবুন তো...

সামান্য এই ভূমিকম্পেই সম্পদের মায়া
ছেড়ে আমরা রাস্তায় নামছি। এটা যখন
আরো বাড়বে, তখন সম্পর্কের মায়াও
ছেড়ে দেবো আমরা। নিজেকে
বাচানোর চেষ্ঠায় ব্রতী হবো সবাই।
যখন তা রচাইতেও আরো বাড়বে তখন
যেই মা দুধ খাওয়াচ্ছেন তিনিও তার
বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন,
গর্ভের শিশুকেও বের করে
দেবেন। ভূমিকম্পের সময় কে কি
বস্থায় ছিলাম, কে টের পেয়েছে,
কে টের পায়নি, চেয়ার টেবিল
নড়ছিলো কিনা, ফ্যান দুলছিলো কিনা- এই
সব গবেষণা পরে করলেও হবে।
আগে করা দরকার তওবা, আল্লাহর কাছে
ক্ষমা চাওয়া। সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি
আল্লাহ কর্তৃক একটি নিদর্শন। যাতে
করে মানুষ স্বীয় অপরাধ বুঝতে
সক্ষম হয়। ফিরে আসে আল্লাহর
পথে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে
আন্তরিকতার সাথে খাটি তওবা করার
তাওফিক দান করুন।

                                  "আমিন"

২টি মন্তব্য: